আজ || রবিবার, ১৯ মে ২০২৪
শিরোনাম :
  রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ডিজাইনকৃত পোশাক নিয়ে ফ্যাশন প্রদ‍‍র্শনী       গোপালপুরে দারোগার মাথা ফাটানোর ঘটনায় ১৬ জনকে জেলহাজতে প্রেরণ       গোপালপুরে দারোগার মাথা ফাটিয়েছে সন্ত্রাসীরা; গ্রেফতার ১০       গোপালপুরে প্রধানমন্ত্রীর ফেয়ার প্রাইজের চাল কালোবাজারে বিক্রির অভিযোগ       গোপালপুরে ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মোমেনের পদত্যাগ       উত্তর টাঙ্গাইল নূরানী মাদরাসার বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান       গোপালপুরে জাতীয় দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবস উদযাপন       গোপালপুরে নানা আয়োজনে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত       গোপালপুরে পৃথক সড়ক দূর্ঘটনায় শিশু ও নারী নিহত       গোপালপুরে অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে নগদ অর্থ প্রদান    
 


গভীর গভীরতর অসুখ এখন

: নুরুল করিম নাসিম : লঞ্চের যে জায়গাটায় যাত্রীরা বসে, সেখানে একজন যুবক অনেকটা জায়গাজুড়ে কুকুর কুণ্ডলী হয়ে শুয়ে আছে। এখনও লঞ্চ ভরে ওঠেনি। একজন-দু’জন করে যাত্রী মাত্র আসা শুরু করেছে। প্রথম ট্রিপ ছাড়তে এখনও চলি্লশ মিনিট বাকি। আমি ও আমার এক সহকর্মী ঢাকা থেকে একসঙ্গে এসেছি। মাওয়াঘাট এক ঘণ্টার পথ, যদি জায়গায় জায়গায় না থেমে বাস সরাসরি আসে। কিন্তু প্রায় সময়ই অধিকাংশ বাস তা করে না। তখন আমার খুব ভোগান্তি হয়। আমি খুব বিরক্ত হয়ে উঠি। ভোর পৌনে ৬টায় গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ডে ব্রিজের নিচে এসে পৌঁছেছি। কারণ, সময়মতো মাওয়াঘাটে পৌঁছে প্রথম লঞ্চ ধরতে হবে। এবার বাসটি মাওয়াঘাটে দ্রুত এসেছে, মাত্র ৪৫ মিনিটে। লঞ্চের টিকিট কেটে যখন এসে বসেছি, হাতে তখন অনেক সময়। আজ পদ্মায় একট একটু ঢেউ আছে। এখন বাংলার জ্যৈষ্ঠ মাসের ছাবি্বশ তারিখ, জুন মাসের দশ তারিখ। এখনও আষাঢ় শুরু হয়নি। কিন্তু আকাশ ঘন মেঘে কালো হয়ে আছে। হয়তো বৃষ্টি হবে। বৃষ্টি হলে পদ্মায় ঢেউ হবে না। জোরে বাতাস বইলে ঢেউয়ে লঞ্চ খুব উথাল-পাথাল করবে। লঞ্চের শিশুরা এবং নারীরা ভয়ে চিৎকার করবে। কোনো কোনো পুরুষ তখন ভর্ৎসনা করে নারী-শিশুদের শান্ত করার চেষ্টা করবে।

এসব আমার অভিজ্ঞতায় এবং জীবনে কোনোদিন ছিল না। আমি নদী, গ্রাম দেখিনি। ইট-কাঠ পাথরের শহরে আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। সাঁতারও আমি জানি না। অথচ এখন আমার নদী পাড়ি দিতে হচ্ছে। ধীরে ধীরে লঞ্চের বাকি জায়গাগুলো ভরে উঠল। আমি যেখানে বসেছি, তার ঠিক উল্টো দিকের সিটে তিনটি মেয়েশিশু ও এক নারী বসেছেন। বয়স ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হবে। বোরখায় পুরো শরীর ঢাকা, শুধু মুখমণ্ডল উন্মুক্ত। ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক। ঠোঁটের চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। একটু দূরের সিটে কালো বোরখা পরা এক বৃদ্ধা সিটে পা উঠিয়ে ঘুমিয়ে আছেন। আমার সহকর্মী রাইমা বলল, লঞ্চ ছাড়তে আর কত দেরি?
আমি নদীর দিকে তাকালাম। ঘাটে আরও তিন-চারটা লঞ্চ দাঁড়িয়ে আছে। যাত্রীরা দ্রুত উঠছে। একটা যাবে কাওড়াকান্দি। আমাদেরটা মাঝিরঘাট। যুবকটির পরনে ময়লা জিন্সের প্যান্ট, হাফশার্ট বিবর্ণ। সে এতক্ষণ পর ঘুম থেকে উঠেছে। তার হাতটা বিকলাঙ্গ। চেহারা ফর্সা ও গোলগাল। সে উঠে কোথাও যেন চলে গেল।
রাইমা বিরক্ত ও অস্থির। তার মাথা ওড়নায় ঢাকা। সে আবার বলল, ক’টা বাজে? আমি আবার নদীর দিকে তাকালাম। অনেক দূরে নৌকা অনেকগুলো। স্থির দাঁড়িয়ে আছে। তার পেছনে মেঘে ঢাকা বিশাল আকাশ মুখ ভার করে আছে। আমার ঘুম পাচ্ছে। ভোর সাড়ে ৪টায় উঠেছি। রাতে ঘুমিয়েছি ১টায়। ঢাকায় গরম। ঠিকমতো ঘুম হয়নি রাতে। সাড়ে ১২টার দিকে গোসল করেছি। তখন কিছুটা প্রশান্তি এসেছে শরীরে। রাইমা হাই তুলল। মনে হয় ওরও ঘুম হয়নি। লঞ্চের ভেতরে বেশ গরম। ভ্যাপসা গরমে খুব অস্থির লাগছে।
রাইমা বলল দুটি মেয়ে এখানে যমজ। টুইন।

আমি বললাম, কী করে বুঝলে? একই রকম, একই ডিজাইনের, একই রঙের ফ্রক পরেছে তিন বোন। এর মাঝে দু’জন যমজ। টুইন। আমি বুঝতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু এই হেঁয়ালির সমাধান করতে পারলাম না। রাইমা পারল। রাইমা অনেক কিছু পারে, যা আমি পারি না।
ভেঁপু বেজে উঠল। কিছুক্ষণ পর আরও দু’বার বাজবে। ঘড়িতে চোখ রাখলাম। লঞ্চ ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। লোকে ভরে যাচ্ছে লঞ্চ। লঞ্চটি নতুন। রঙের গন্ধ বেরোচ্ছে। একটা স্পিডবোট খুব দ্রুত চলে গেল। হাতে সময় কম থাকলে শীত মৌসুমে আমি স্পিডবোটে গেছি কয়েকবার। ১৬০ টাকা ভাড়া। এখন বর্ষাকাল। এখন যাই না। ভয় লাগে।
আবার ভেঁপু বেজে উঠল। ঘাটে হৈচৈ পড়ে যাচ্ছে। দুটো অল্পবয়সী ছেলে দড়ি খুলে দিচ্ছে। সারেং গোল চরকির মতো চাকা ঘোরাচ্ছে। লঞ্চ পানি কেটে কেটে এগোচ্ছে। এখন একটু একটু বাতাস বইতে লাগল।

একজন রোগামতন ক্যানভাসার একটি লাল ব্যাগ থেকে ওষুধ বের করে খুব আকর্ষণীয় ঢংয়ে ও চমৎকার ভাষায় বক্তৃতা করছে। গ্যাস্ট্রিক ও হার্টের অসুখের হারবাল ওষুধ, অব্যর্থ ওষুধ। কেউ কেউ ১০০ টাকায় কিনছে। আমার গ্যাস্ট্রিক নেই, হৃদয়ও ভালো কিন্তু পৃথিবী ভালো নেই। তার গভীর গভীরতর অসুখ এখন। সন্ত্রাস বেড়ে গেছে পৃথিবীব্যাপী, ব্যাংক হ্যাকিং হচ্ছে, দেশে দেশে যুদ্ধ হচ্ছে, দিন দিন মানুষের অবস্থা খারাপ হচ্ছে।
রাইমাও ভালো নেই। ও তার মায়ের সঙ্গে থাকে। বাবা বেঁচে নেই। স্বামীর সঙ্গে বনিবনা হয়নি, ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় বিয়ের দু’বছর পর। এখন ঢাকার বাইরে এক অরণ্যঘেরা গ্রামে একটি এনজিওতে চাকরি নিয়ে ভালো আছে। কিন্তু সত্যি কি রাইমা ভালো আছে? নদীর দিকে চেয়ে কী যেন ভাবছে সে। একটু দূরে চর। পদ্মায় চর জেগে উঠেছে। এক বৃদ্ধ বললেন, পদ্মা মইরা গেছে, আগের মতো নাই।

কিন্তু এত ঢেউ কোত্থেকে আসে? নদী এত উত্তাল হয় কী করে? এই পদ্মা একদিন আমাদের সমস্ত জমিজমা-বাসস্থান কেড়ে নিয়েছে। প্রপিতামহ, মানে আমার দাদার কাছে সেই করুণ গল্প শুনেছি। তখন চলি্লশের দশক। বিক্রমপুর মুন্সীগঞ্জে আমাদের আবাস ছিল। পদ্মা তখন ভয়ঙ্কর ছিল। তার আগ্রাসী আক্রমণে আমাদের বসতি, জমিজমা, বাড়িঘর নদীতে হারিয়ে যায়। দাদারা দু’ভাই ছিলেন। তারা ঢাকায় এসে আবার নতুন আবাস গড়েন। পুরান ঢাকায় আমার জন্ম। আমার কোনো গ্রাম নেই। আমি জন্মেছি ঢাকা শহরে, পুরান ঢাকায়। পদ্মার বুকের ওপর দিয়ে প্রতি সপ্তাহে আমাকে যেতে হয় একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানে। তখন এসব কথা মনে হয়।

এই পদ্মা নিয়ে কত কবিতা, কত গান রচিত হয়েছে। কিন্তু ওর ভয়ঙ্কর আগ্রাসী রূপ নিয়ে কেউ কিছু লিখেছে কি-না জানি না। এবার ডিম বিক্রেতা এলো। তারপর এলো দু’জন ভিখিরি। বেশ স্বাস্থ্যবান। মসজিদের চাঁদা চাইতে এলো একজন টুপিপরা মুখভর্তি দাড়ি মধ্যবয়সী লোক। অনেকে টাকা দিচ্ছে, কেউ কেউ দিচ্ছে না। রাইমা তার ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে দশ টাকা বের করে লোকটির হাতে দিল। আমি মনে মনে হাসলাম। রাইমা তা লক্ষ্য করল। কিছু বলল না। এরপর এলো এক অন্ধ লোক। সেও সুর তুলে গান গেয়ে সাহায্য চাইছে।
হঠাৎ লঞ্চে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেল। মূল পদ্মায় লঞ্চ ঢুকেছে। নদীতে অসম্ভব ঢেউ। লঞ্চ ভীষণ দুলছে। সারেং আপ্রাণ চেষ্টা করছে নিয়ন্ত্রণে রাখতে। বৃষ্টি, বৃষ্টি। ঝড় শুরু হয়ে গেল। প্রবল বাতাস বইছে।

গত বছর একটি লঞ্চ ডুবে অনেক মানুষ মারা গেছে। রাইমার চোখেমুখে ভয়। ভয় আমারও লাগছে। আমি সাঁতার জানি না। শেষ পর্যন্ত সলিল সমাধি? রাইমা কাঁদছে। আমি সান্ত্বনা দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করছি; যা রাইমা কখনও করেনি, তাই করল এই বিপদসংকুল মুহূর্তে। আমার হাত চেপে ধরল। শিশুরা ভয়ে কাঁদছে, নারীরা ভয়ে চিৎকার করছে। সেই লোকটি যে মসজিদের জন্য চাঁদা তুলছিল, সে সূরা পাঠ করছে আর বলছে, আপনারা আল্লাহর নাম নেন, সূরা পাঠ করেন।

সারেং লঞ্চটা নদীর তীরে নিয়ে এসেছে। লঞ্চটি স্থির হয়ে থেমে আছে। এই অঞ্চলে হোন্ডা অন্যতম বাহন। অটো আছে, বাসও চলে। গত সপ্তাহে বৃষ্টি ছিল। হোন্ডায় যাইনি। বাসে গেছি। বেশ ভিড় ছিল। বাস থেকে নেমে লঞ্চে উঠেছি মাঝিরঘাট থেকে। দেখি লঞ্চে রাইমা বসে আছে। ওর মুখোমুখি বসলাম। আমাকে পেয়ে বা বলা যায় ওকে পেয়ে আমি খুব উচ্ছ্বসিত। টিকিট ভাড়া আমি দিয়ে দিলাম। ও জোরাজোরি করল, ওর বারণ শুনলাম না। টুকটাক কথা বলতে বলতে সময়টা ভালো কেটে গেল। আমার হাতে রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্র। একসময় দু’একটি চিঠি পড়লাম। রাইমাকে পড়ালাম। যখনই আমি পদ্মা পাড়ি দিই, আমার সফরসঙ্গী হিসেবে ‘ছিন্নপত্র’ থাকে। আরও দু’একটি বই থাকে। যখন একা থাকি। পড়ি। রবীন্দ্রনাথ পদ্মা নদীতে বোটে ঘুরে বেড়াতেন আর লিখতেন। সেসব চিঠিতে পদ্মার চমৎকার বর্ণনা রয়েছে। রাইমা জিজ্ঞেস করল, রবির বৌদি কাদম্বরী দেবী কেন আত্মহত্যা করল? আমি কিছু বললাম না।

বিশাল নদী আকাশের সঙ্গে এমনভাবে মিশে আছে, মনে হচ্ছে যেন ওরা মিতালি করেছে। মাওয়ায় নেমে বাসেও একসঙ্গে এলাম। আমি নেমে যাব গুলিস্তানে, রাইমা উত্তরা। বাবুবাজার ব্রিজের ওপর চিরাচরিত ভিড়। প্রায় এক ঘণ্টা থেমে রইল বাস। ঢাকায় যানজটে ভরা জীবন। এখন যাত্রীরা অনেকটা শান্ত। বাতাস নেই। ঝড়ো হাওয়া আর বইছে না, কিন্তু প্রবল বৃষ্টি পড়ছে আকাশ ভেঙে। মনে হচ্ছে সমস্ত আকাশ ফুটো হয়ে গেছে।
রাইমার দিকে তাকালাম। তার মুখ বৃষ্টিক্লান্ত আকাশের মতো থমথম করছে। আমার খুব মায়া হচ্ছে। ইচ্ছে করছে ওর মুখটা তুলে ধরি। ওর চোখে বেদনা ছায়া ফেলেছে। চোখের নিচে কালো দাগ। রাতে ঘুম হয় না। কী কারণে তার সংসার ভেঙে গেল, সে কথা সে কখনও বলেনি। পদ্মা কত ঘরবাড়ি-সংসার ভেঙে তছনছ করে ফেলেছে। এই নদীর সঙ্গে কোথায় যেন মিল আছে রাইমার। রাইমা সুখী হতে চেয়েছিল, পারেনি। সে একটি শান্তিময় সংসার চেয়েছিল। সে একটি মানুষ চেয়েছিল। পায়নি। শুনেছি, তার স্বামী মধ্যরাতে বাড়ি ফিরে তার গায়ে হাত তুলত। বেদম মারধর করত। একদিন, দু’দিন, তিনদিন। তারপর একদিন রাইমা ঘুরে দাঁড়াল। শিক্ষিত মেয়ে হৈচৈ না করে নীরবে তাকে ত্যাগ করে চলে গেল।

বৃষ্টি কমে এসেছে। মনে পড়ছে গত সপ্তাহের কথা। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। আমার কর্মস্থল থেকে ঢাকা অভিমুখে যাত্রা। সচরাচর হোন্ডায় যাই। ৪০০ টাকা প্রতিজন। মনটা খারাপ হয়ে যায়। ঢাকায় এলে মাওয়ার ওপারে ফেলে আসা কর্মস্থলের জন্য মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। ঢাকা আর বাসযোগ্য নেই। যানজট, মানুষের ভিড়, অসহ্য গরম। আকাশ নেই। গাছপালা নেই।
এতক্ষণ তীরে থিতু হয়ে থাকা লঞ্চ চলতে শুরু করল। এখন বৃষ্টি কমে গেছে। তবে পুরোপুরি থামেনি। যাত্রীদের চোখেমুখে আর শঙ্কা নেই। সবাই বাক্স-প্যাটরা আর জিনিসপত্র গোছাচ্ছে। রাইমা বলল, আমি আর লঞ্চে আসব না। ফেরিতে আসব। আমি মৃদু হাসলাম। আবার যখন সামনের সপ্তাহ আসবে, যদি আবহাওয়া ভালো থাকে, তখন রাইমা তার প্রতিশ্রুতি রাখবে না। আমিও তখন লঞ্চযাত্রী হবো। ফেরির সময়সূচির সঙ্গে লঞ্চের সময়সূচি মেলে না। কাঁঠালবাড়ী থেকে ফেরিতে উঠতে হয় সকাল সাড়ে ৮টা অথবা দুপুর ২টা। কোনোদিনই ফেরি সময়মতো ছাড়ে না। পুলিশের বড় কর্তা কিংবা এমপি অথবা কোনো প্রভাবশালী নেতা ফেরিতে ভ্রমণ করলে সময়সূচি বদলে যায়। তখন সাধারণ মানুষের ভোগান্তি হয়। কেউ কিছু বলতে পারে না। ভেঁপু বেজে উঠল। লঞ্চ মাঝিরঘাটে পৌছাবে। যাত্রীদের ধৈর্য নেই। সবাই বাইরে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে গেছে। আরও দশ মিনিট লাগবে তীরে পৌছাতে। পেছনে পড়ে রইল প্রিয় শহর ঢাকা। যেখানে আমার জন্ম, আমার বেড়ে ওঠা।
আমাদের কর্মস্থল জায়গাটা জনবহুল নয়। চারদিকে গাছপালা আর অরণ্য। সত্তর দশকের দিকে এখানে চরমপন্থিদের আস্তানা ছিল। এরা সর্বহারা পার্টি নামে পরিচিত। অত্যাচারী চেয়ারম্যানদের আর স্বৈরাচারী জোতদারদের এই সর্বহারা পার্টির সদস্যরা হত্যা করত। আশির দশকেও এই চরমপন্থিরা এসব অঞ্চলে সোচ্চার ছিল। এখন তেমন একটা নেই। এসব মানুষ কোথায় গেল, যারা সমাজকে বদলাতে চেয়েছিল? লঞ্চ এসে তীরে ভিড়তে চেষ্টা করছে। দু’জন লোক ভারী মোটা দড়ি ছুড়ে দিচ্ছে জেটির দিকে। সেখানে যে দু’জন লোক দাঁড়িয়ে আছে, তারা দড়ি দিয়ে নোঙর বাঁধছে। যেন এই বাঁধন শক্ত হয়ে নোঙরকে ধরে রাখে। ঠিক মানুষের জীবনের মতো। আমার পেছনে রাইমা। তার হাতে একটা ব্যাগ। তার ভেতর খাবার মা বানিয়ে দিয়েছে। এক সপ্তাহের খোরাক। এই খাবার একটু একটু করে সারা সপ্তাহে খাবে সে। তারপর আবার বৃহস্পতিবার এলে, ঢাকায় চলে যাবে। কীভাবে যাবে সে এখন জানে না। সে শুধু এটুকু জানে, সারা পথের ক্লান্তি শেষে আবার শুরু হবে জীবন, আবার শুরু হবে কাজ। ঢাকা থেকে এই মাঝিরঘাট, তারপর এক-দেড় ঘণ্টার স্থলপথে বাস। শরীর কিছু থাকে না। এখানে রাস্তা আঁকাবাঁকা ও সরু। এত ঝাঁকি যে, শরীর ব্যথা হয়ে যায়। আমি নামলাম প্রথমে। রাইমা দাঁড়িয়ে আছে সম্রাজ্ঞীর মতো। বাতাসে লঞ্চ দুলছে একটু একটু। আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম। রাইমা আমার হাত ধরে নামল এমনভাবে যেন এই শক্ত অবলম্বন কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন না হয়ে যায়।

মন্তব্য করুন -


Top
error: Content is protected !!